Friday, July 22, 2016

তাবলিগ জামাতের মসজিদভিত্তিক পাঁচ কাজ ও ইসলাম!


বর্তমান পৃথিবীতে দ্বীনের যত মেহনত চলছে, তার মধ্যে দাওয়াতে তাবলিগ নিঃসন্দেহে সর্বাধিক সফল মেহনত। এই বরকতপূর্ণ মেহনত আজ দুনিয়ার সব জায়গায় পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর সব দেশে এবং সব এলাকায় একই নিয়মে চলছে তাবলিগের কাজ। কাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নবী-রাসুলগণ সাহাবাদের কর্মপদ্ধতি হুবহু অনুসরণ করা। তাই তাবলিগের কাজে আধুনিক যুগের মানবরচিত চিন্তা-চেতনা কর্মপদ্ধতির কোনো স্থান নেই। দাওয়াতে তাবলিগের সব কাজ সুন্নাতে রাসুল মোতাবেক করা হয়। হুজুর [সা.] যেভাবে নামাজ পড়েছেন, যেভাবে খেয়েছেন, যেভাবে ঘুমিয়েছেন, যেভাবে মানুষকে ইসলামের পথে দাওয়াত দিয়েছেন-তার সবই অনুসরণ করা হয় তাবলিগের কাজে। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের মাঝে কিভাবে পুরোপুরি ইসলাম আসে, সে ব্যাপারেও রয়েছে সুন্দর নিয়ম। নিজে আল্লাহর হুকুম নবীর তরিকা অনুযায়ী জীবন যাপনের পাশাপাশি নিজের পরিবারের সদস্যরা, পাড়া-প্রতিবেশী এবং আশপাশের সবাই যেন দ্বীনদার আল্লাহওয়ালা হয়ে যায়। দাওয়াতে তাবলিগের এটাই প্রধান লক্ষ্য।

তাবলিগের বিভিন্নমুখী দ্বীনি কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মসজিদের পাঁচ কাজ। এই পাঁচ
কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এর দ্বারা একটা সমাজ পরিবর্তিত হতে পারে। সমাজের খারাপ মানুষগুলো ভালো হয়ে যেতে পারে। বেনামাজি লোকেরা নামাজি হয়ে যেতে পারে। যা গোটা মুসলিম জাতির জন্য এক সুখময় কাঙ্ক্ষিত বিষয়। এখন আমরা জেনে নিই যে কোন কোন কাজকে পাঁচ কাজ বলা হয়। পাঁচ কাজ হলো-. প্রতিদিন মাশওয়ারা বা পরামর্শ করা। . প্রতিদিন মসজিদে ঘরে তালিম করা। . দৈনিক আড়াই ঘণ্টা ফিকির করা [মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে আড়াই ঘণ্টা সময় ব্যয় করা। . প্রতি সপ্তাহে নিজ মহল্লায় অন্য মহল্লায় গাশ্ত করা। অর্থাৎ আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার লক্ষ্যে ঘুরাফিরা করা। . প্রতি মাসে আল্লাহর রাস্তায় তিনদিন সময় লাগানো।

. মাশওয়ারা-মসজিদে প্রতিদিন কোনো এক নামাজের পর মাশওয়ারা বা পরামর্শ করা। এলাকার তাবলিগের সব সাথীকে নিয়ে পরামর্শ করা হয়। পরামর্শে সাধারণ মানুষও অংশ নিতে পারে। এর দ্বারা এলাকার সব মানুষকে কিভাবে নামাজি বানানো যায় এবং পুরুষদের মসজিদমুখী করা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এরপর সেই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করা হয়। গতকাল যারা মসজিদে এসেছিল, তারা আজ এসেছে কি না, সে বিষয়েও খোঁজখবর রাখা হয়। যদি কেউ না এসে থাকে, তাহলে কেন এলো না, তা জানার চেষ্টা করা হয়। সে যদি কোনো কষ্টে থাকে, তাহলে তার কষ্ট দূর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। শারীরিক অসুস্থতা থাকলে তার সেবাযত্নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তা ছাড়া গতকালের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে কি না বা কতটা অগ্রগতি হলো, তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়। বলা যায়, তাবলিগের কাজে মাশওয়ারাই হলো মূল চালিকাশক্তি। নিয়মিত পরামর্শের সুন্নাত তরিকা অনুসরণ করার বরকতে এই মেহনত আল্লাহপাক কবুল করেছেন। কাজ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাবলিগের পরামর্শে দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ থাকে না। ব্যক্তিগত কোনো প্রভাব থাকে না। সবাই দ্বীনের স্বার্থে খেয়াল দেয় এবং পরামর্শের আমির সবার মতামত শুনে ফায়সালা দেন। ফায়সালা দেওয়ার পর তার ওপর অটল থেকে কাজ করা হয়।

. তালিম-প্রতিদিন কোনো এক নামাজের পর মসজিদে তালিম করা। মসজিদের মুসল্লিদের নিয়ে এই তালিম করা হয়। তালিমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনি প্রেরণা সৃষ্টি হয়। তালিম করা হয় 'ফাজায়েলে আমাল' নামের বিশ্বনন্দিত গ্রন্থ থেকে। এই গ্রন্থে দ্বীনের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, নামাজ, ইলম বা জ্ঞানার্জন করা, জিকির, কোরআন পাঠের গুরুত্ব তাৎপর্য এবং সাহাবাদের বিভিন্ন ঘটনা সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। তাই এই কিতাব থেকে তালিম করার কারণে মানুষের মধ্যে এসব বিষয়ের প্রতি প্রকৃত জ্ঞান আমলের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একান্ত জরুরি। ছাড়াও ফাজায়েলে সাদাকাত, হায়াতুস সাহাবা, মুনতাখাব হাদিস নামের বিশ্বখ্যাত কিতাব থেকেও তালিম করা হয়। পৃথিবীর বিজ্ঞ আলেমগণ ব্যাপারে একমত যে এসব কিতাব মানুষের জীবন পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাবলিগী মেহনতে মসজিদে তালিমের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিশেষভাবে নারী শিশুদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান আমলের স্পৃহা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ঘরে তালিমের ব্যবস্থা করার প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই প্রত্যেক তাবলিগে সময় লাগানো ব্যক্তি নিজ নিজ ঘরে তালিম করে থাকে। ঘরে তালিম করার মধ্যে বহুমুখী উপকারিতা নিহিত রয়েছে। আমাদের সমাজের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা হলো নারী। নারীদের অন্ধকারে রেখে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই পরিবারের মধ্যে শিশু নারীরা যেন ভালো পথে পরিচালিত হয়, সেজন্য ঘরে তালিমের গুরুত্ব অপরিসীম। যা আমাদের সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে এবং সমাজ পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মনে রাখতে হবে, আজ যে সন্তান ঘরে বেড়ে উঠছে, তারাই একদিন বড় হবে। দেশ দশের জন্য কাজ করবে। সমাজে কল্যাণ বয়ে আনবে। তাই আজ যদি তালিমের মাধ্যমে তাদের অন্তরে ইমানের বীজ বপন করা হয়, আমলের বৃক্ষ রোপণ করা হয়, তাহলে তাদের কর্মজীবনেও এর প্রভাব পড়বে। তারা সততার সঙ্গে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে। সৎপথে নিজে চলতে এবং অন্যকে চালাতে প্রস্তুত থাকবে। মুসলমানদের সুখে-দুঃখে সব সময় তারা পাশে থাকবে। তখনই সম্ভব আমাদের দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা। তাই ঘরে তালিমের গুরুত্ব অপরিসীম।

. ফিকির-দৈনিক আড়াই ঘণ্টা ফিকির করা। অর্থাৎ তাবলিগের প্রত্যেক সাথী তার দিনের ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আড়াই ঘণ্টা সময় মানুষকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয়ার জন্য ব্যয় করবে। আড়াই ঘণ্টার এই মেহনতে সমাজের সব মানুষের মধ্যে দ্বীনি দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। তাই পাঁচ কাজের মধ্যে দৈনিক আড়াই ঘণ্টা ফিকির অন্যতম।

. গাশত-সপ্তাহে একদিন নিজ মহল্লার মসজিদে গাশ্ত করা এবং অন্য একদিন পাশের মহল্লার মসজিদে গাশ্ত করা। গাশ্ত অর্থ মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বানের উদ্দেশ্যে কিছু সময় ঘুরাফেরা করা। গাশ্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। এর উছিলায় সাধারণ মানুষের কাছে দ্বীনি দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া হয়। নিজ মহল্লার মসজিদে এই আমল চালু থাকলে নিজ এলাকার মানুষ ধীরে ধীরে আল্লাহর পথে আসতে থাকে। যারা নামাজ পড়ত না, তারা নামাজে আসা শুরু করে। আর অন্য মহল্লায় গাশ্ত করার দ্বারা আশপাশের এলাকায়ও দ্বীনি পরিবেশ কায়েম হতে শুরু করে। সেখানে যারা তাবলিগের কাজে নিয়োজিত আছেন, তাদের মধ্যেও নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রেরণা সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া এর মাধ্যমে উভয় মহল্লার সাথিরা পরামর্শের ভিত্তিতে কাজের মধ্যে গতি আনতে পারে। বর্তমান যুগের জন্য পদ্ধতি খুবই ফলপ্রসূ একটি আমল।

. তিন চিল্লা-মাসে তিনদিন সময় লাগানো। প্রতি মাসে যদি কেউ যদি তিনদিন সময় লাগায়, তাহলে দ্বীনের ওপর অটল থাকা তার জন্য সহজ হয়। সময় লাগালে দেখা যায়, তার মধ্যে তাবলিগের কাজের গুরুত্ব আসে। আমলের মধ্যে এখলাস সৃষ্টি হয়। হৃদয়ে আল্লাহর ভয় আসে। তা ছাড়া সহিহ-শুদ্ধভাবে নামাজ পড়ার যাবতীয় নিয়মাবলি শিখা যায়। সুন্নত তরিকা অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো অজু-গোসলসহ সব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ হয়। মোটকথা, একজন মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহর হুকুম নবীর তরিকা প্রতিষ্ঠা করার যাবতীয় নিয়মাবলি তাবলিগ জামাতে শিখানো হয়। তাই আমাদের উচিত তাবলিগের এই নীরব বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

মুফতি মুহাম্মদ আল আমিন
লেখক : খতিব, বাইতুর রহমত জামে মসজিদ, গাজীপুরা, টঙ্গী।

No comments:

Post a Comment