ইজতেমা আরবি শব্দ। অর্থ হলো- সম্মেলন বা সম্মিলন। এর বানানগত উচ্চারণ হলো- 'ইজতিমা'; বাংলায় ইজতেমা বা এজতেমা লেখা হয়। ইজতেমা শব্দটিকে বিভিন্ন বানানে লিখতে দেখা যায় এবং বিভিন্ন উচ্চারণে বলতে শোনা যায়। যেমন- এস্তেমা, ইস্তেমা, ইস্তিমা ইত্যাদি। শেষোক্ত শব্দ তিনটির মূল হলো, 'সামা', যার মানে শোনা বা শ্রবণ করা, সঙ্গীত করা বা গীতি শোনা। সুতরাং এস্তেমা বা ইস্তেমা অর্থ হবে শ্রবণেচ্ছা। 'ইজতেমা'র সঙ্গে 'ইস্তিমা'র শব্দগত ও উচ্চারণগত সম্পর্ক বা ভাবগত মিল দেখা গেলেও এর ভাব ও উদ্দেশ্য এবং অন্তর্নিহিত সম্পর্ক গৌণ।
ইজতেমা শব্দটি 'জমা' শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ হলো- বহু, অনেক, মিলন, মিলানো, স্থিতি। এছাড়া
বিভিন্ন অর্থে এর ব্যবহার রয়েছে। যেমন- 'জামাআত' দল, বর্গ, শ্রেণী; 'জমায়েত' মিলনমেলা, একত্রকরণ; 'জমিয়ত' সংগঠন; 'মাজমুআহ' সমগ্র, সাকুল্য, সম্মিলিত, একত্রিত; 'মাজমা' (মজমা) মজলিশ, সভা, সমাবেশ, মিলনস্থল; 'মুজাম্মা' কমপ্লেক্স, কেন্দ্র; 'জামিআ' সকলে, সম্মিলিতভাবে, একত্রে; 'জামি' বড় মসজিদ, জামে মসজিদ বা জুমুআ মসজিদ; 'জামেয়া' (জামিআ) একত্রকারী, বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি; 'মুজতামা' সমাজ, সভ্যতা; 'জুমুআ' সভা দিবস, শুক্রবার; 'জুম্মা' মাথা; 'জিম' গর্ভস্থ সন্তান, ভ্রূণ; 'জিমা' মিলন করা, উপগত হওয়া; 'মুজামাআ' সঙ্গমন, রতিরমন, দাম্পত্যবরণ; 'ইজমা' সম্মিলিত, ঐকমত্য; 'আজমা' পূর্ণাঙ্গ; 'জাম' অবয়ব গঠন ও রূপ লাভ নিমিত্তে শুক্রবিন্দু জরায়ু জঠরে ৪০ দিন অবস্থান করা এবং ৪০ দিন পরপর সুরত পরিবর্তন করা। (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর : ২/৩৫৫-৩৬০)।
আল্লাহ বলেন, 'তোমরা সবাই সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়রূপে অাঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।' (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
'বিশ্ব ইজতেমা' হলো বিশ্ব সভা, বিশ্ব সম্মেলন, আন্তর্জাতিক সমাবেশ তথা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স। এর আরবি হলো- আল ইজতিমা আল আলামি, আল ইজতিমা আদদুওয়ালি, আল ইজতিমাউ বাইনাল মিলালি। 'বিশ্ব ইজতেমা' নামের দুইটি শব্দের প্রথমটি বাংলা, দ্বিতীয়টি আরবি শব্দ। যা উর্দু, ফারসি ও হিন্দিতেও ব্যবহৃত হয়। সব মিলে 'বিশ্ব ইজতেমা' পরিভাষাটি বর্তমানে বাংলা রূপ লাভ করেছে।
পরিভাষায় 'বিশ্ব ইজতেমা' হলো- দেওবন্দি ঘরানার অন্তর্গত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রবর্তিত 'কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিহে নিয়ত ও তাবলিগ'- এ ছয় মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত 'তাহরিকুস সালাত' বা 'নামাজ আন্দোলন' নামে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে 'তাবলিগ জামাত' নামে পরিচিত মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি কর্মধারার তিন দিনব্যাপী বার্ষিক কর্মশালা সমাবেশ। যা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ তীরে প্রতি বছর সাধারণত জানুয়ারিতে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এতে বিশ্বের পঞ্চাশের অধিক দেশের ৫০ লক্ষাধিক লোক অংশগ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে এখানে বিশ্বের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ইজতেমার আগে ১০ দিনের জোড় হয়।
প্রথম দিকে এ ইজতেমা শনি, রবি ও সোমবার এই তিন দিন অনুষ্ঠিত হতো। সোমবারে জোহরের আগে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটত। কার্যত দেখা যেত অধিকাংশ লোক শুক্রবারে জুমার আগেই চলে আসেন এতে তিন দিনের ইজতেমা চার দিন গড়ায়। তাই পরবর্তী সময়ে সুবিধা বিবেচনায় শুক্র, শনি ও রোববার করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ দলমত নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ আখেরি মোনাজাতে শামিল হন। তাই আখেরি মোনাজাতের দিন রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল থাকে এবং অফিস আদালতগুলো অঘোষিত ছুটি থাকে।
এখান থেকে ছয় গুণে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক লোক আল্লাহর দেয়া জান-মাল সময় নিয়ে আল্লাহকে রাজি খুশির উদ্দেশ্যে দ্বীনি দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের জন্য এক চিল্লা (৪০ দিন), তিন চিল্লা, সাত চিল্লা, সাল ও ১০ চিল্লা এবং জীবন চিল্লার জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন।
দাওয়াত তাবলিগের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- 'আমর বিল মারুফ' (সৎকাজে আদেশ) ও 'নাহি আনিল মুনকার' (মন্দ কাজে নিষেধ)। মহান আল্লাহ বলেন, 'তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করো, অসৎকার্যে নিষেধ করো এবং আল্লাহে বিশ্বাস করো।' (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।
মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
Post collect from: Daily ittefaq
No comments:
Post a Comment